তালাক
লিখেছেন লিখেছেন মামুন ১৭ অক্টোবর, ২০১৪, ১০:৫৭:৪৭ সকাল
প্রচন্ড রৌদ্র মাথায় নিয়ে জমিতে কাজ করেছে আলম মোল্লা। মই দিয়ে লেভেলিং এর কাজ শেষ করে হালের বলদ দুটিকে সাথে নিয়ে জোয়াল কাঁধে বাড়ির পথ ধরল। খুব পরিশ্রান্ত বিধ্বস্ত দেহ নিয়ে পথের পাশে গাছের ছায়ায় একটু জিরাতে দাঁড়ায়। বলদ দুটি ইতরামি শুরু করেছে। ও দুটি দাড়াতে চাচ্ছে না। বাড়ির পরিচিত পথের দিকে মালিককে রেখেই চলে যেতে চাচ্ছে।
পেটে প্রচন্ড ক্ষুধা। শরীর চলতে চাইচ্ছে না। হাতের লাঠিটি দিয়ে ইচ্ছেমত দুটিকে পিটায় কিছুক্ষণ। পরক্ষণেই বোবা পশু দুটির উপর এই নির্মমতায় মনটা ভারাক্রান্ত হয়ে পড়ায় অদেরকে সাথে নিয়েই বাড়ির পথ ধরে।
জোবেদা এখনো রান্না শেষ করতে পারে নাই। শাশুড়ির ক্রমাগত ঘ্যানঘ্যানানি আর অসুস্থ শ্বশুরের সেবা করায় আজ অনেক দেরী হয়ে গেল। রান্না করতে গিয়ে দেখে লাকড়ি শেষ। পিছনের বাগানে গিয়ে শুকনো ডালপালা ভেঙ্গে এনে এই মাত্র চুলায় আগুন ধরিয়েছে। এই সময়ই আলম উঠানে প্রবেশ করে হাঁকডাক শুরু করে।
: কই গেলা? ভাত দাও শীগগির। জান শ্যাষ হইয়া গেলো।
বলদ দুটিকে গোয়ালে রাখতে সেদিকে আগায়। জোয়াল ও মইটা যথাস্থানে রেখে পুকুরের দিকে ডুব দিতে গেলো।
গায় মাথায় সরিষার তেল দিয়ে ঘরের দাওয়ায় মাদুর বিছিয়ে বসে খাবারের অপেক্ষায় বসে থাকে। আবারো জোবেদাকে ডাকলে সে রান্নাঘরে বসে উত্তর দেয়-
: আরো একটু বার চান, সালুন অহনো হয় নাই।
মুহুর্তে তেলেবেগুনে জ্বলে উঠে আলম। পেটের ক্ষুধা আর একটু আগের পরিশ্রান্ত দেহে অবোধ জানোয়ার দুটিকে পিটানোর ক্লান্তিকর স্মৃতি তাকেও জানোয়ারে পরিণত করে দেয়। নিজেকে নিজের ভিতরে মানুষের রুপে রাখা আর হয়ে উঠেনা। মাটির দাওয়া থেকে বসেই একটা অশ্রাব্য গালি দিয়ে উঠে দাঁড়ায়। হাতের কাছের পানির জগ জেলাস লাথি দিয়ে ফেলে দিয়ে রান্না ঘরে অপেক্ষারত জোবেদার দিকে আগায়। মুখ দিয়ে ফুলঝুরির মত বের হয়ে চলেছে গালির ধারা।
কিছুটা অবাক হয় জোবেদা। মানুষটা আজ এমন করছে কেন?! আগুয়ান আলমের রণমুর্তি দেখে এবার একটু ভয় পায়। সে কিছু বুঝে উঠার আগেই ওর চুলের মুঠি ধরে টেনে উঠানে নিয়ে আসে আলম। কিল, চড় আর লাথি-ঘুষির দ্বারা ব্যথা যতটুকু না পায়, দুঃখটা বেশী পায়। আলমের অসুস্থ বাবা বিছানায় বসে চীৎকার করে ওকে থামতে বলে। শাশুড়ি মনে মনে খুশী হয়। দেবরেরা যার যার ঘর থেকে উঁকি দিয়ে দেখে কেবল। জোবেদার চাচা শ্বশুর একবার চেঁচিয়ে এগুলো কি হচ্ছে বলেই ঘরের বারান্দায় দাঁড়িয়ে থাকেন। কিন্তু কেউই এগিয়ে আসে না আলমকে থামাতে।
আলমের হাতের সাথে সাথে মুখও একই গতিতে চলতে থাকে, ' খিদায় মইরা যাইতাছি, মাগি তুই সারাদিন কি করছোস? কোন নাগরের সাথে ..তে গেছিলি যে ভাত-তরকারি রান্ধোস নাই?
জোবেদার মুখ দিয়ে শুধু একবার বের হয়, ' হারা বাড়ির কাম তো আমারেই করন লাগে। আমনে আ কথা কইবেন না কইলাম।'
আগুনে ঘি ঢালার কাজটি করে ফেলে যেন জোবেদা। ওকে ছেড়ে দিয়ে শ্তির হয়ে কোমরে দু'হাত দিয়ে দাঁড়ায় আলম। রাগে কাঁপতে থাকে। এবার নিজেকে সম্পুর্ণ রুপে শয়তানের উপর ছেড়ে দেয় যেন। দাত কিড়মিড় করে উচ্চ স্বরে বলে-
: আমারে চোট দেহাস? যা মাগি তোরে আর রাখলামই না। তোরে তালাক দিলাম। এক তালাক, দুই তালাক, তিন তালাক.. যা আআম্র বাড়িত্থোন বাইর হ ।
এতোক্ষণ এতো মারধরে যা হয় নাই, এই সামানয কথাতে অসামান্য প্রতিক্রিয়া দেখায় জোবেদা। প্রথমটায় সে বুঝে উঠে না আলম কি বলল। পরক্ষণেই সে নির্বাক হয়ে যায়। দাঁড়ানো অবস্থা থেকে উঠানের মাটিতে বসে পড়ে। দু'চোখ বেয়ে পানির সাথে হৃদয়ের রক্তক্ষরণও বের হতে থাকে!
অন্যরা এবারে ওর থেকে বেশী প্রতিক্রিয়া দেখায়। শাশুড়ি সবার আগে ছুটে আসেন-
: এইডা কি করলি বাজান? এক্কেরে তালাক দিয়ে দিলি?!
চাচা দাওয়া থেকে নীচে নামেন। বলেন,
: কামডা ঠিক অইলো না। অহন তো আর ওরে চাইলেও তুই ঘরে রাখবার পারবি না। তিন তালাক অইয়া গ্যাছে।
চাচার দিকে তাকিয়ে আলম সরোষে বলে,
: কেডা রাখতে চায় ওরে? - একথা বলে নিজের ঘরের দাওয়ায় বসে যায় সে।
জোবেদা যেখানে বসে ছিল সেখানেই বসে থাকে। এইমাত্র ওর পৃথিবীটা কিভাবে যেন অন্য রুপ নিয়ে অন্য কোথায় চলে গেছে। রিক্ত, বেদনার্ত একাকী সে সেখানেই পড়ে থাকে। ওর শ্বশুর চীৎকার করতে থাকে, 'হারামজাদা এইডা তুই কি করলি? এইডা কি করলি?
বিকেলের ভিতরে পুরা গ্রামে ছড়িয়ে যায় আক্কাস মোল্লার বড় পোলা তার বউরে তিন তালাক দিছে। গ্রামের মাতবর আব্দুল জলিলও এ কথা জানল। অনেকদিন ধরে জোবেদার একহারা শরীরের দিকে তার নজর ছিল। আভাষে ইঙ্গিতে অনেকবার জোবেদাকে কুপ্রস্তাব দিয়েও ছিল সে। জোবেদা ঘৃনা এবং লজ্জায় তাকে অপমান করে ফিরিয়ে দিয়েছে। এবার সে একহাত দেখে নেবার সুযোগ পেল।
সেদিন সন্ধ্যায় মাতবরের আঙ্গিনায় এই তালাকের ব্যাপারে সালিশ বসে। আলম, জোবেদা সহ ওদের আত্মীয় স্বজনেরাও উপস্থিত হয়। আলম রাগের মাথায় জঘন্য কাজটি করার পর থেকে রাগ কমে এলে অনুশোচনায় জর্জরিত হয়। কিন্তু ঘটনা অনেকদূর গড়িয়ে গেছে ততক্ষণে।
সবাই যখন তাকে জিজ্ঞেস করে, সে কেন জোবেদাকে তালাক দিল? উত্তরে মাথা নীচু করে থাকে সে। মিনমিন করে বলে সে রাগের মাথায় কথাগুলো মুখ দিয়ে বের করে দিলেও তার মনে তালাকের ইচ্ছেটা ছিল না। সে জোবেদাকে নিয়েই ঘর করতে চায়।
কিন্তু মাতবর বলে যে, তালাক হয়ে গেছে। এখন আর জোবেদাকে নিয়ে থাকা শরীয়ত সম্মত হবে না। জোবেদাকে পুনরায় হিল্লা বিয়ে দিয়ে এরপরে সে ঘরে নিতে পারবে। উপস্থিত অন্যরাও মাতবরের কথায় মাথা নেড়ে সমঝদারের মত সায় দেয়। এলাকার মসজিদের ইমাম সাহেবও চুপ করে থাকেন। মাতবরের অভিপ্রায় তার কথাতে বুঝেই তিনি নীরব থাকতেই সম্মত হন।
এভাবে একটি সুন্দর পারিবারিক জীবন ক্রোধের বশবর্তী হয়ে সামান্য কিছু লাগামহীন কথার দ্বারা গ্রাম্য সমাজে চলে আসা এক অলিখিত বিধানকে কার্যকর করার অপেক্ষায় নষ্ট হবার উপক্রম হয়। সঠিক ইসলামী জ্ঞানের অভাবে এভাবে অনেক আলম এবং জোবেদারা সমাজপতিদের ভুল-মনগড়া শরয়ি বিধানের অপপ্রয়োগের দ্বারা বিচ্ছিন্ন হতে বাধ্য হচ্ছে।
এবার আমরা দেখবার চেষ্টা করব কোরআন হাদীসের আলোকে এই তালাকের কি বিধান রয়েছেঃ-
যারা নিজেদের স্ত্রীদের নিকট গমন করবেনা বলে কসম খেয়ে বসে তাদের জন্য চার মাসের অবকাশ রয়েছে অতঃপর যদি পারস্পরিক মিল-মিশ করে নেয়, তবে আল্লাহ ক্ষামাকারী দয়ালু।আর যদি বর্জন করার সংকল্প করে নেয়, তাহলে নিশ্চয়ই আল্লাহ শ্রবণকারী ও জ্ঞানী। (২:২২৬-২২৭)
যদি তাদের মধ্যে সম্পর্কচ্ছেদ হওয়ার মত পরিস্থিতিরই আশঙ্কা কর, তবে স্বামীর পরিবার থেকে একজন এবং স্ত্রীর পরিবার থেকে একজন সালিস নিযুক্ত করবে। তারা উভয়ের মীমাংসা চাইলে আল্লাহ সর্বজ্ঞ, সবকিছু অবহিত। (৪:৩৫)
হে নবী, তোমরা যখন স্ত্রীদেরকে তালাক দিতে চাও, তখন তাদেরকে তালাক দিয়ো ইদ্দতের প্রতি লক্ষ্য রেখে এবং ইদ্দত গণনা করো। তোমরা তোমাদের পালনকর্তা আল্লাহকে ভয় করো। তাদেরকে তাদের গৃহ থেকে বহিস্কার করো না এবং তারাও যেন বের না হয় যদি না তারা কোন সুস্পষ্ট নির্লজ্জ কাজে লিপ্ত হয়। এগুলো আল্লাহর নির্ধারিত সীমা। যে ব্যক্তি আল্লাহর সীমালংঘন করে, সে নিজেরই অনিষ্ট করে। সে জানে না, হয়তো আল্লাহ এই তালাকের পর কোন নতুন উপায় করে দেবেন। (৬৫:১)
কোরআন তালাকের ব্যাপারে স্পষ্টভাবে উল্লেখ করেছে যে, তালাক দিতে হলে অবশ্যই একটা নির্দিষ্ট সময় পর্যন্ত অপেক্ষা করেত হবে।
আল্লাহপাক আমাদেরকে ক্রোধের বশবর্তী হয়ে অসংলগ্ন কথাবার্তা না বলার এবং সঠিক ইসলামী জ্ঞান অনুযায়ী জীবন চলার তৌফিক দান করুন-আমীন।
বিষয়: বিবিধ
১০১২ বার পঠিত, ১৯ টি মন্তব্য
পাঠকের মন্তব্য:
এখনো এদেশের গ্রামীন সমাজে এরকম ঘটনা অতি স্বাভাবিক ব্যাপার।
অনুভূতি রেখে যাবার জন্য আপনাকে অনেক অনেক শুভেচ্ছা।
জাজাকাল্লাহু খাইর।
বরাবরের মত ই অসাধারণ হ্রদয়গ্রাহী নান্দনিক উপস্হাপনা, অনেক ধন্যবাদ ও শুভেচ্ছা...।
সবচেয়ে নিকৃষ্ট অনুমোদিত বৈধ বিষয়'তালাক'। আরশ কাপানো এই নিকৃষ্ট বৈধ বিষয়ে যথেষ্ট'দ্বীনি ইলম' না থাকায় সমাজে এর যথেচ্ছা ব্যবহার মারাত্মক আকার ধারণ করেছে।
বিয়ে-তালাক বিষয়ে সামাজিকতার চেয়ে ধর্মীয় গুরুত্ব অনেক বেশী এবং এর শুদ্ধতা নিরুপমে রাষ্ট্রীয় আইনের মোকাবেলায় প্রকৃত শরয়ী হুকুম কে প্রাধান্য দিতে হবে-একজন প্রকৃত মুসলিম ব্যক্তি হতে হলে।
বিয়ে-তালাক বিষয়ে রাষ্ট্রীয় কানুন ও শরয়ী কানুন কিছু জায়গায় সাংঘর্ষিক বাংলাদেশে।
দেশের প্রচলিত আইনানুযায়ী সাময়িক স্বার্থ উদ্ধার হলেও পরকালীন 'ধরা' অবশ্যম্ভাবী।
'তালাক' সম্পর্কে 'মুফতি'দের ফতোয়াই সবচেয়ে গ্রহনযোগ্য।
খুব সুন্দরভাবে বিষয়টির সারাংশ মন্তব্যে তুলে ধরলেন, সেজন্য জাজাকাল্লাহু খাইর।
আপনার দোয়ায় আমীন।
জাজাকাল্লাহু খাইর।
ধন্যবাদ আপনাকে।
জাজকাল্লাহু খাইর।
খুবই সুন্দর একটা লেখা ভাইয়া ধন্যবাদ ।
জাজাকাল্লাহু খাইর।
জাজাকাল্লাহু খাইর।
আমার ব্লগে আপনাকে স্বাগতম।
অনুভূতি রেখে যাবার জন্য অনেক অনেক শুভেচ্ছা ।
আপনার দোয়ায় আমীন।
জাজাকাল্লাহু খাইর।
জাজাকাল্লাহু খাইর।
অনেক দিন পরে আমার ব্লগে এলেন?
অনুভূতি রেখে যাবার জন্য আপনাকে অনেক অনেক ধন্যবাদ।
জাজাকাল্লাহু খাইর।
আপনার পরিকল্পনা সাফল্যমন্ডিত হোক
আপনাকে আন্তরিক ধন্যবাদ
মন্তব্য করতে লগইন করুন